প্রকাশিত: Sat, Apr 1, 2023 1:28 PM
আপডেট: Wed, Jun 25, 2025 1:06 PM

মিডিয়াওয়াচ প্রথম আলোর প্রতিবেদককে গ্রেপ্তার এবং সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে কিছু কথা

আরশাদ মাহমুদ : প্রথমেই বলে রাখি আমি প্রথম আলোর সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রায়ই লিখে থাকি এবং আমি সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুরাগী নই। কিন্তু গত দু’দিনে যা ঘটেছে, সেটা শুধু স্বাধীন সাংবাদিকতা বা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বড় হামলা নয়। বরং এটা সমগ্র দেশ এবং জাতির জন্য একটা অশনি সংকেত। আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন, প্রতিবেদক শামসুজ্জামান গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত একটি খবর নিয়ে সরকারের রোশানলে পড়েছে। শামসুজ্জামান যে রিপোর্টটি করেছেন, সেটা তো কোনো বানোয়াট বা মনগড়া ব্যাপার নয়। দেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং গরিব মানুষ যে খাদ্য সংকটে ভুগছে, এটা তো কোনো অজানা বিষয় নয়। 

মাত্র কয়েকদিন আগে সানেম নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে খাদ্য দ্রব্যের অশ্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে নিম্নবিত্তদের মধ্যে আঠারো ভাগ মানুষ একদিন সম্পূর্ণ অনাহারে কাটিয়েছে। ছয় মাস আগে এদের সংখ্যা ছিলো ৯.৭৫ ভাগ। অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে একদিন অভুক্ত থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। সানেম আরও উল্লেখ করেছে, তাদের গত সার্ভেতে প্রায় ১৮ ভাগ নিম্নবিত্তের মানুষ বলেছিলো যে তারা খিদে সত্ত্বেও খাবার খুব একটা খেতে পারেনি। ৬ মাস পর নেওয়া তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ ভাগ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাস্তবতার ভিত্তিতে করা প্রথম আলোর রিপোর্টটি সরকারকে কেন এতো বিব্রত করলো এবং তাদের এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কেন দেখাতে হলো। এর একটা উত্তর সম্ভবত তথ্য মন্ত্রী হাসান মাহমুদ দিয়েছেন। একটি টিভি চ্যানেলে শুনলাম তিনি বলছেন যে, প্রথম আলোর ওই সংবাদটি নাকি রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে আঘাত হেনেছে। একটা রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য যদি হয় সব নাগরিকের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং যদি রাষ্ট্র সেটা করে থাকে, তবে রিপোর্টটা ছিলো অবশ্যই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। কিন্তু এ কথা তো সর্বজনবিদিত যে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই সব নাগরিকের জন্য, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণির জন্য এই মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এই অভাব, অনটন, দীনতা যতদিন থাকবে ততোদিন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হবে না এবং তারা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকবেন। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই, এমনকি অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলোতেও এই অবস্থা বিরাজমান। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে আমেরিকাতেও অনেক মানুষ এই মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে প্রায়ই রাস্তায় বিক্ষোভ করেন এবং এই ইস্যুগুলো প্রায়ই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, দিনমজুর জাকির হোসেন যে বক্তব্য দিয়েছেন অর্থাৎ তার ভাষায় ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ-মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’। এটা তো বাস্তবের প্রতিফলন। আমার মনে হয় এই বাস্তবতাকে অকপটে স্বীকার করে নিয়ে এই সমস্যাগুলো আরও কীভাবে কার্যকর ভাবে মোকাবেলা করা যায় সেটা নিয়ে শেখ হাসিনা জাতির সামনে তার পরিকল্পনাগুলো বলতেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হলে জাকির হোসেনের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলতাম যে আমি আপনার দৈনিক খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিনি সেজন্য আমি অপরাধী এবং লজ্জিত। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে আপনাদের মতো এরকম অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা মানুষদের আমি নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করবো। একবার চিন্তা করে দেখেন যে, জাকির হোসেনকে সামনে নিয়ে শেখ হাসিনার এই একটি বক্তব্য যদি টেলিভিশনে প্রচার হতো, তাহলে তিনি শুধু নিজেকে একজন মানবিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেন না। বরং সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা আশার আলো ছড়িয়ে দিতে পারতেন। 

একইসঙ্গে তিনি প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে ডেকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাতেন এই রিপোর্টটি করার জন্য এবং তাকে বলতেন যে আপনি দেশ এবং জাতির একটা বড় উপকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটা না করে প্রতিবেদককে জেলে নেওয়া হলো এবং প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে একটা ভীতিকর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো। আমি জানি না কীভাবে এতে শেখ হাসিনা বা তার সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সরকারের এই অস্বাভাবিক আচরণ কি তাদের অসহিষ্ণুতার একটা বহিঃপ্রকাশ? নাকি মূল সমস্যাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে নির্যাতন নিপীড়নের মাধ্যমে সুস্থ সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করা। শেক্সপিয়ারের একটা উক্তি দিয়ে শেষ করছিÑ ‘ডোন্ট শুট দ্য ম্যাসেঞ্জার’। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক